১
-
ছাড়ো তো বাল! জানা আছে! উপন্যাস লিখবে, ফিলিম বানাবে, সব করবে
তুমি... ক্যানো ফালতু এসবের মধ্যে জড়াচ্ছো নীলু? তুমি মনে করো তুমি সত্যিই পারবে
একটা উপন্যাস লিখতে? একটাও ঠিকঠাক চরিত্র আঁকতে জানো তুমি?
-
না, বিশ্বদা, ব্যাপারটা একটু বোঝো... মানে আমার কোনো উপায় ছিলো না...
-
আবার তোমার বালের কথা... যাকগে... আমি মরছি আমার নিজের জ্বালায়...
-
জানো বিশ্বদা, যে কোনো জায়গা থেকেই শুরু হতে পারে একটা উপন্যাস...
প্রাচীন শব্দগুলো
উল্কি ও খুব ক্রুশকাঠে
গলে যাচ্ছে প্রিয়
ঋতু ও ঋতুহনন
পাতাদের আসবাবে বিবর্জিত
ক্রিয়াপদে
এই দিকচিহ্ন এই ছুটে যাওয়া মনক্যামন
স্মৃতিহীন হয়ে পড়ছে...
ফিরে এসে দেখি, সারা ঘরে টুকরো টুকরো হয়ে আছে নীল। অথচ এরকম কথা ছিলো না। এই তো, কিছু আগেই খুব কায়দা
করে ঘাড়টা একটু কাত করে ঋষিদার ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে
দাঁড়িয়ে গ্রিলে একটা হাত রেখে ওকে বলে এলাম, “ঘুরে দাঁড়ানোই যায় গো ঋষিদা, ইচ্ছে করলেই... কতো আর
বয়স তোমার?” ঋষিদা বললো, “জানিস, ও আমার জীবনের সাত-সাতটা বছর... জানিস, আমি তখন টেনেটুনে ছত্রিশ...
ছত্রিশটা একটা বয়স? বল? আর পারছিনা জানিস... প্রতিদিন ভোররাত থেকে বিছানায় উঠে বসে
থাকি। একা একা একা একা... রোজ রোজ রোজ... দেওয়ালগুলো না, কাছে এগিয়ে আসে, জানিস? মাঝে মাঝে ভাবি, আমি এই
একতলার একা ফ্ল্যাটে যদি মরে পড়ে থাকি...” আমি বললাম, “কিন্তু তুমি তো অনেক অনেক
মেয়ের সঙ্গে...” কথাটা ও শেষ করতে দেয়নি। বলেছিলো, “বাড়ি যা নীলু... তোর বৌ তোর
ভ্যানোপ্রসাদ ওয়েট করছে, অনেক রাত হোলো...” তারপর নিজের হ্যালানো চোখদুটো আরেকবার দাঁড় করাতে করাতে বললো, “কুমারী মেয়েদের ক্ষেত্রে তুই
তো নাভি পর্যন্ত গেছিস, তার নীচে তো আর কখনো নামতে পারিস নি ওদের শরীরে...”
দেখছিলাম কীভাবে এই শহর
মিশিয়ে ফেলছিলো সুদীপ্ত সেন আর আইপিএল। মিডিয়া আর জনগণের, নাকি জনগণ আর মিডিয়ার, আপাতত এই দুটোই মাইলফলক। অজান্তেই। অথবা ঘোর সজ্ঞানে? আর প্রায় তখনি ভ্যানোপ্রসাদ
বললো, “বাবা, ওই দ্যাখো, একটা
হাট্টিমাটিম গাছ।“ যেকোনো লোকাসের আনাচেকানাচে এভাবেই একটা-আধটা মাইলফলক বসিয়ে রাখে ও, সবে পাঁচ। হাহ, সেই যে, একটা গাছের
থেকে আরেকটা গাছের দূরত্ব... আমরা বাড়াই কমাই। প্রতিদিন। আমি আর ভ্যানো। আমার মেয়ে। সবে পাঁচ।
২
“সমস্ত শীতকাল তুমি পাখি হয়ে পাখির ভিতর কাটালে”
১২/১২/২০০০
দুপুর তিনটে
হায়দরাবাদ
বিদিশা,
আজ অনেকদিন বাদে তোকে লিখতে বসেছি। আজকাল চিঠি লেখা হয় না। কখন লিখবো বুঝি না। সোম – রবি সপ্তাহে ৭ দিন অফিসে আসি। কাজ যে খুব তা নয়, কিন্তু চলে আসি। বাড়ি থেকে ফেরার পর শনি –
রবিবার C++
শিখতে যাওয়া শুরু
করেছি। শেখার
চেয়ে বড়ো কথা – অফিসের পয়সায় কোর্সটা হয়, এটাই। শনিবার সন্ধ্যে জুড়ে আর রবিবার সকাল। রবিবার বিকেলে আবার অফিসে চলে আসি। সময় যে একদম পাই না তা নয়, আসলে যখন পাই,
আর লিখতে ইচ্ছে করে না।
তোর খান তিনেক চিঠি এসেছে। একটা করে আসে আর ভাবি এবার লিখবো। কি জানি – কিছুই করা হয়ে ওঠে
না। আর লিখবোটাই বা কী
? পড়াশুনো কর, শরীরের যত্ন নে – এছাড়া তোকে আমার কিছুই বলার নেই। মা-বাবার কথা শুনিস –
আর কিছুই না। ঘুরতে যাচ্ছিস - আরো যাওয়ার সুযোগ আসবে –
খুব মজা। ইস,
আমি যদি এরকম একটা course করতে পারতাম। অবশ্য আমার সেরকম সুযোগই ছিল না। সাবধানে ঘুরিস –
এতো স্বাধীনতা পাস – সেটাকে অপব্যবহার করিস না। জন্মদিন উপলক্ষ্যে তোর পাঠানো কার্ডটা
পেয়েছি।
সেটা খুললে আবার গান-বাজনা হয়। তোকে এই জ্ঞানগুলো এত দেওয়ার দরকার নেই জানি –
তুই বড়োও হয়েছিস বুঝি।
তাও দিয়ে দিই – আর কিছু তো দেওয়ার নেই। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব – এরা তেমন important নয় – এগুলো ভুল কথা। আত্মীয়স্বজনেরা শুভাকাঙ্ক্ষী –
আমি খুব মিশতে পারিনি।
এখন মনে হয় ভুল হয়ে গেছে।
এই আত্মীয়স্বজনেরা আছে বলেই মা-বাবা আমাকে ছেড়ে থাকতে পারছে। তবে তোর বেশ কিছু অকালপক্ব উল্টোপাল্টা বন্ধুবান্ধব আছে –
তাদের থেকে সাবধান।
এদের সাথে খুব একটা ঘনিষ্ঠতা বোধহয় ভালো নয়। বাড়ি যাবার আগে তোকে জানাই নি। আসলে আজকের অয়ন তোর সাথে ফোন নিয়ে অতক্ষণ
বকবক করতে পারবে কি না আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অবাক হচ্ছিস! ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখিস তো
একবার।
আমি কখনোই “wonderful
person throughout” নই –
হতেও চাই না।
২০/১২/২০০০
সকাল সাড়ে সাতটা
হায়দরাবাদ
এক সপ্তাহের বেশী gap পড়ে গেল। অবশ্য মাঝখানে Postal strike চলায় লিখলেও লাভ হত না। এবার চিঠিটা বড্ড দেরী হয়ে গেল। আসলে আজকাল কাগজ পেন নিয়ে বসা হয়ে ওঠে না। এখান থেকে একে একে সকলেই চাকরি ছেড়ে অন্য
চাকরি করতে যাচ্ছে – আমাদের সাথে join করা
অনেকেই ছেড়ে দিল।
ছেড়ে দিয়েও শান্তি নেই, অন্যান্য company গুলো টাকাপয়সা ভালো দেয় –
বাইরেও পাঠায়, তবে কাজের এমন চাপ... অবশ্য এখানেই বা কী করছি –
কী করা উচিত বুঝতে পারি না। এক এক সময় এক এক রকম mood হয়। এক বাঙালী দাদা resign করেছে
আমাদের group থেকে। আমার এক বন্ধু ভুবনেশ্বর থেকে এখানে কয়েকমাসের
জন্য transfer হয়ে এসেছিলো – সে কলকাতায় চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর নীলু চাকরি খুইয়ে কলকাতায় ফিরে গেছে
কিছুদিন আগে – কিছু বলার নেই। classmateদের মধ্যে যারা দেশে বিদেশে লেখাপড়া করছে –
তারা ভাগ্যবান।
আর ফিরে যাওয়া যাবে না – আফশোস করে লাভ নেই। আমিও অনেক বদলে গেছি। সবাই যায় ? কি জানি। বেশী কথা বলার অভ্যেস চলে গেছে। তুই phone-এ যা বললি শুনলাম। এগুলো আমি চাই নি। লজ্জা লাগলো খুব –
কোনো উত্তরই দিতে পারলাম না। এখানে মেয়েদের সাথে interaction NIL হয়ে গেছে – তোর সাথে বকবক করতেও পারবো না –
অভ্যেস চলে গেছে।
নিজেকে, মা-বাবাকে, আত্মীয়স্বজনদের সময় দে। আমার জ্ঞানগুলো তোর ভালোর জন্যই। ভালো কথা, জানিস, আজকাল চিঠি পাইও খুব কম। নীলু তো এতদিন এখানেই ছিল, চিঠির ব্যাপার
ছিল না... আর মা-বাবাকে ছেড়ে থাকা রপ্ত করে ফেলেছি – বাকিগুলো তো খুব
সোজা। বাবা বোধহয় ছেলের career উদাসীনতা
নিয়ে চিন্তিত।
কিছু একটা ভাবতেই হবে।
গতসপ্তাহে আমার ছোটবেলার একজন বন্ধু আর college-এর এক বন্ধু বিদেশ চলে গেলো হঠাৎ করে। মা-বাবা নিশ্চয়ই এসব নিয়েও ভাবে। খুব দিশেহারা অবস্থার মধ্যে আছি। খুব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে চিঠি। শেষ করি এবার। ভালো থাকিস। তোর ওপর কোন রাগ নেই আমার –
আমার রাগ হয় নিজের ওপর।
চেষ্টা করব চিঠি লেখার।
তবে নিয়মরক্ষার মতো অত লিখতে পারব না। তুই লিখিস। একটাই অনুরোধ – শরীরের যত্ন নিস। ভালো থাকিস। হাঁটুর বয়সী হলেও তোর চাইতে অনেক ছোট আমি
– মানুষ হিসেবে। বুঝলাম। চিঠি লিখবো।
অয়ন ব্যানার্জী